স্কুল ছুটির পর স্কুল হোস্টেলের বারান্দায় একদল ছেলে গোল হয়ে বসছে। সবগুলোই ল্যাবরেটরি স্কুলের ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ছাত্র, কিন্তু তারা এমনভাবে আড্ডা মারছে যেন মনে হচ্ছে তারা সবাই সমবয়সী, যেন একি ক্লাসে পড়ে। আগের ক্লাসের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর স্কুলে অনেকদিন ছুটি ছিলো। সবার সাথে অনেকদিন কারোই যোগাযোগ হয়নি। আজ প্রায় এক মাসের পর তাদের দেখা। ছুটিতে কে কি করলো, কে কোথায় বেড়ালো এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে আড্ডা বেশ জমে গেছে।
প্রথমে কথা হলো কে কোথায় ঘুরতে গেছে। সাবিম, যে কিনা ক্লাস এইটে পড়ে আর যার বাপ মায়ের অনেক টাকা থাকা সত্ত্বেও নিজেদের চার নাম্বার ছেলেকে হোস্টেলে পাঠিয়েছে, সে বলল এবার সে নাকি আমেরিকায় বেড়াতে গেছিলো! তার কথা শুনে তো সবাই অবাক, কেউ কেউ আবার হিংসায় জ্বলেপুড়ে যাবার ভান করছে। যেমন সুভ্র বলছে, ইশ, তোর কি ভাগ্যরে সাবিম! এতো কম বয়সে আমেরিকার মতো মারাত্মক দেশেও ঘুরে এলি! তোরা নিশ্চয়ই অনেক বড়লোক। কিন্তু তারপরেও আমার মনে প্রশ্ন জাগছে।
সুভ্র মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, তোরা এতো বড়লোক হওয়া সত্ত্বেও তোর বাপ তোকে হোস্টেলের মতো একটা ক্ষ্যাত জায়গায় থাকতে পাঠালো কেন?
সাবিম বেশ দুঃখ গলায় বলে, কি আর বলব দোস্ত। চারটা ছেলেমেয়ে হয়েছে। আমার সবচেয়ে বড় ভাইকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়ছে, মেজ ভাইকে পড়ায়ছে ইংলিশ ভার্সন স্কুলে, ছোট ভাইয়াকে পড়ায়ছে বাংলা মিডিয়াম স্কুলে আর আমার বেলায় তাদের মাথায় ভূত চাপলো যে সবচেয়ে ছোট ছেলেকে বোর্ডিং স্কুলে পড়াবে! এই ব্যপারে যে ওদের সাথে কত ঝগড়া করলাম কিন্তু বোর্ডিং স্কুলের ভূত যে আর নামে না দোস্ত! শেষে হাল ছেড়েই দিলাম।
সাবিমের কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। সাবিমও হাসতে লাগলো। কারণ সে এখন মনে করে, বোর্ডিং স্কুলে পড়ে হোস্টেলে থাকাটা মনে হয় খুব একটা খারাপ না।
তারপর এরকম চলতেই থাকলো। সাবিম ছাড়া সবাই দেশের মধ্যে ঘুরাঘুরি করেছে। কেউ কক্সবাজার ঘুরে এসেছে কেউ আবার রাঙ্গামাটি, কেউ আবার সুন্দরবনে যেয়ে একটি ভৌতিক বাড়িও দেখে আসছে সেটার কাহিনি আবার সে খুব আগ্রহ নিয়ে বলল। আড্ডাটা বেশ জমে গেছে কিন্তু আড্ডায় একটি ছেলে খুব শান্তভাবে বসে আছে। ছেলেটির নাম ফাহিম। তার যে আড্ডায় কোন আগ্রহ নাই তা না, সে চুপ করে বেশ আগ্রহ নিয়েই সবার কথা শুনছে। কোন কথা বলছে না।
আড্ডাটা কিভাবে কিভাবে যেন বইপত্র বিষয়ে চলে আসলো। ছুটিতে কে কি বই পড়ছে এ ব্যাপারে সবাই কথা বলছে। বেশ সঙ্গত কারণেই সবাই ফাহিমকে ছেঁকে ধরলো। কারণ তাদের মধ্যে একমাত্র ফাহিমই আছে যে এক্সট্রিম লেভেলের একজন বইপোকা হিসেবে পরিচিত। এই ছেলে প্রচুর বই পড়ে। সময় পেলেই বই হাতে নিয়ে বসে থাকে। হোস্টেলে থাকার জন্য সবার একটি করে সুটকেস থাকে। ফাহিমের আছে দুইটা সুটকেস। একটা কাপড়চোপড়ের জন্য। অন্যটা বইয়ে ভর্তি থাকে। বইবিষয়ক কোন কথা আসলে সবাই এজন্যই ফাহিমকে ছেঁকে ধরে।
ফাহিমের এই আড্ডাতে অংশগ্রহণ করার কোন ইচ্ছা ছিলো না। তার খুব ইচ্ছা করছিলো নতুন ক্লাসের নতুন বইগুলোতে একটু চোখ বুলাতে। কিন্তু সবসময় সবকিছু করা যায় না। বইগুলোতে চোখ বুলানোর উপযুক্ত সময় এটি না।
সে বলতে শুরু করলো, এই ছুটিতে আমি খুব আজব একটা বই পরছি। বইয়ের নাম Optical illusion and mind reading। একজন জনপ্রিয় সাইকিয়াট্রিস্ট এই বই লিখেছেন।
সবার চোখ কপালে উঠে গেলো। শুভ্র বলল, বাপরে বাপ। কি নাম বললি? আরেকবার বলতো?
ফাহিম বিরক্ত হয়ে আরেকবার নামটা বলল।
শুভ্র বলল, বিশ্বাস কর ভাই। নাম শুনেই তো আমার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। নামই যদি এত কঠিন হয় তাহলে বই যে কত কঠিন হবে আল্লাহই জানে।
ফাহিম বলল, বই একটু কঠিনতো বটে। তবে এই বই থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।
হুম, এই বই তাহলে বিরাট জ্ঞানের বই। কত্থেকে জোগাড় করছিস।
কোত্থেকে জোগাড় করছি মনে নাই। মনে হয় আব্বুকে কেউ গিফট দিয়েছিলো কিন্তু আব্বু জীবনে এই বইতে হাত দেয়নি।
কয় পেজের ছিলোরে বইটা?
এক হাজার বারো পেজ!
সর্বনাশ! সাবিম বলে, এতো মোটা বই এক মাসে পড়ে ফেললি? নাকি পুরোটা পরিস নাই?
পুরোটাই পড়েছি।
ও। সাবিম বলে, তুই তো আবার বেশি বই পড়তে পারিস কিনা। তো বই পড়ে কি শিখলি?
অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু কয়েকটা ব্যপারে আমার খটকা লেগেছে। যেমন হিপনোটিক সাজেশানের ব্যাপারটা। এই এক্সপেরিমেন্টটা আমি আগে একটু প্রাকটিক্যালি করে দেখতে চাই।
আড্ডায় শান্ত নামে একটা ছেলে ছিলো। সে বলল, তার আগে তো এটা বল হিপনোটিক সাজেশানটা কি?
আচ্ছা বলছি। ফাহিম বলে, তার আগে বল ঐযে টিভিতে ম্যাজিশিয়ানরা মানুষকে হিপনোটাইজ করে, তাদেরকে কন্ট্রোল করে, ম্যাজিশিয়ান তাদেরকে যা বলে তারা তাই করে।ব্যাপারটা তো দেখেছিস,নাকি?
কতবার দেখেছি। শান্ত বলে।
সাবিম বলে, কিন্তু ওগুলোতো ভুয়া জিনিস। আসলে তো আর হিপনোটাইজ করা যায়না। তারা ভান করে আর আমাদের মতো বুদ্ধিমান দর্শকদের তারা বোকা বানায়।
আড্ডায় আবার ছোটখাটো একটা হাসির বান বয়ে গেল। কিন্তু ফাহিম বলল, আসলে হিপনোটাইজ সত্যি সত্যি করা যায়। কিন্তু হিপনোটাইজ হওয়ার আগে কিছু ক্রাইটেরিয়া অনুসরণ করতে হয়। যেমন আমি যাকে হিপনোটাইজ করবো তাকেই চাইতে হবে আমি যেন তাকে সম্মোহন করি। এবং হিপনোতাইজ করার আগে ভিক্টিমের মাথায় ছোটখাটো একটা চাপ তৈরি করতে হবে। যেমন তাকে একটা ভূতের গল্প বলে তাকে ভয় পাইয়ে দিলাম। ফলে তার মনে এক ধরনের চাপ তৈরি হলো। এটি একধরনের চাপ। আরেকটি ক্রাইটেরিয়া হলো তার মস্তিষ্ককে ক্লান্ত করে দিতে হবে। ধর তাকে বীজগণিতের কুয়েকটি অঙ্ক করতে দিলাম। তার মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে গেলো। এসব ধাপগুলো অনুসরণ করতে পারলেই তাকে আমি হিপনোটিক সাজেশান দিতে পারবো। অর্থাৎ তাকে আমি হিপনোটাইজ করতে পারবো।
শুভ্র বিরক্ত হয়ে বলল, এসব কি তুই ওই উদ্ভট বই থেকে শিখছিস?
ফাহিম মাথা নারলো, হ্যা।
ধুর, এসব তুই সব ভুল শিখছিস। হিপনোটাইজ বলে কিছু নাই। সব ভূয়া কথা।
এজন্যই তো আমি প্রথমেই বলেছি ব্যাপারটা আমি একটু প্র্যাকটিক্যালি এক্সপেরিমেন্ট করতে চাই। ব্যাপারটা খোলাসা না করে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে থাকতে চাই না।
এবার ব্যাপারটায় অনেকেই আগ্রহী। হাসিন নামের ছেলেটা বলে উঠলো, আহ শুভ্র ভাই। আপনি শুরুতেই ভূয়া কথা ভূয়া কথা বলে চেচাচ্ছেন কেন? ব্যাপারটা নিয়ে নাহোয় একটা পরিক্ষা হয়েই যাক!
শুভ্র একটু নরম হলো, ঠিক আছে, ফাহিম তাহলে তুই হাসিনকে হিপনোটাইজ কর। আমরা নাহয় একটু মজা দেখি আর নিশ্চিত হই, হিপনোটাইজ সত্যি করা যায় নাকি যায় না!
হাসিন ভয়ে ভয়ে বলল, না বাবা! আমি কেন। আমি ছাড়াতো আরো অনেকেই আছে।
সাবিম আনন্দিত গলায় বলল, ঠিক আছে ফাহিম, তুই আমাকে হিপনোটাইজ কর। এখানকার সব গুলা একেকটা ভিতুর দল।
আড্ডার কেউই সাবিমের ভিতু বলার অপমানটা গায়ে মাখলো না। কারণ সবাই ভাবছে, একটু পর তাদের কত মজা হবে। ফাহিম সাবিমকে বলল, ঠিক আছে সাবিম। তুই একটা কাজ কর। ফাহিম ব্যাগ থেকে একটা গণিতের বই বের করে বলল, পেজ নম্বর পঞ্চাশের দশ আর বারো নাম্বার অঙ্কটা কর। আমি ততক্ষণ কয়েকটা জিনিস নিয়ে আসি।
সাবিম হই হই করে উঠলো, কেন? হিপনোটাইজ হওয়ার জন্য ম্যাথ করা লাগে নাকি?
হ্যা লাগে। হিপনোটাইজ হওয়ার জন্য তোকে অবশ্যই তোর ব্রেনকে ক্লান্ত করতে হবে। এটি হিপনোটাইজ হওয়ার প্রথম ধাপ।
কিন্তু আমি তো দশ নাম্বার অঙ্কটা পারবো না। বারো নাম্বারটা পারবো।
ঠিক আছে। ফাহিম বলে, তাহলে তুই যে যে অঙ্ক পারবি সেগুলো করতে থাক, আমি আসছি। ফাহিম চলে গেলো আর সাবিম বিমর্ষ মুখে অঙ্ক করতে লাগলো।
ফাহিম আর সাবিমকে ঘিরে আড্ডার সবাই গোল হয়ে বসেছে। সবার চোখেই আগ্রহের ছাপ। শুধুমাত্র ফাহিম আর সাবিম ব্যতিক্রম। সাবিমের এখন কেমন যেন ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে আর ফাহিম একদম গম্ভীর। সে তার ব্যাগ থেকে একটা খুলি বের করলো। আস্ত একটি মানুষের খুলি। সবাই ভয় পাওয়ার মতো মৃদু একটি চিৎকার দিলো। সাবিম ভয় পাওয়া গলায় বলল, হায় হায়, মানুষের খুলি আনছিস কেন এখন?
ফাহিম মৃদু হেসে বলল, হিপনোটিক সাজেশানের দ্বিতীয় ধাপ হলো যাকে হিপনোটাইজ করছি তার মনে সূক্ষ্ম একটি চাপ তৈরি করতে হবে। খুলিটা আনছি তোর মনে চাপ তৈরি করার জন্য।
ভাই অনেক হয়েছে। এখন খুলিটা ব্যাগে ঢুকা। খুলিটা দেখে কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে।
না সাবিম। খুলির এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। ফাহিম খুলিটা একটা সুতা দিয়ে বাধলো। বেধে ফাহিম সেটি সাবিমের মুখোমুখি ঝুলিয়ে রাখলো।
শোন সাবিম, ফাহিম বলল, তুই কি চাচ্ছিস আমি তোকে আমার বশে আনি?
হ্যা, কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আমার এখান থেকে উঠে পড়া উচিত।
না সাবিম, তোকে এখন মনেপ্রাণে চাইতে হবে, আমি যেন তোকে বশ করি। এটি সম্মোহন করার তৃতীয় ক্রাইটেরিয়া। নাহলে তোকে হিপনোটাইজ করা যাবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে। সাবিম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আমি মনেপ্রাণে চাই ফাহিম যেন আমাকে হিপনোতাইজ করে।
গুড। ফাহিম এখন খুলির সাথে বাঁধা সুতাটি একবার বায়ে নাড়ে একবার ডানে নাড়ে। আড্ডার সবাই অবাক হয়ে ফাহিমের কার্যকলাপ দেখতে থাকে। ফাহিম বলে, সাবিম তুই এখন পুরোপুরি খুলির দিকে তোর দৃষ্টি মননিবেশ কর। খুলি যেদিকে যাচ্ছে তোর চোখও সেদিকে যেন যায়।
খুলি ডানে বায়ে নড়ছে। তার সাথে সাবিমের চোখের মনিও ডানে বায়ে নড়ছে। সাবিমের ঘুম আসছে। চোখ বন্ধ করতে ইচ্ছা করছে আবার চোখ খোলা রাখতেও ইচ্ছা করছে।
সাবিম এখন আমার কথা মন দিয়ে শোন। ফাহিম বলে, তুই কল্পনা কর, তুই একটি নির্জন প্রান্তরের মাঝখানে। তোর আশেপাশে কেউ নাই। তোর ঠিক সামনে একটি সিড়ি আছে। সিড়ি দেখতে পাচ্ছিস তো?
হ্যা দেখতে পাচ্ছি। সাবিম বলে।
এখন তুই এই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠবি। প্রথমে এক ধাপ উপরে উঠ। উঠেছিস?
হ্যা উঠেছি। সাবিম উত্তর দিল।
এখন মন দিয়ে শোন, তুই যখন সিড়ির পঞ্চম ধাপ উপরে উঠবি সাথে সাথে তুই একটি ছাগলে রুপান্তরিত হবি! কিসে রুপান্তরিত হবি?
ছাগলে রুপান্তরিত হবো। সাবিম ঘোর লাগা গলায় উত্তর দিলো।
আড্ডার সবার মাঝে একটি হাসির আভাস তৈরি হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কেউ হাসল না। কোন একটি অজানা কারণে সবার নিশ্বাসই ভারি হয়ে এসেছে।
সাবিম,ফাহিম বলছে, এখন তুই দ্বিতীয় ধাপ পার হবি, তারপর তৃতীয় ধাপ, তারপর চতুর্থ ধাপ, তারপর আমি হাততালি দিবো, হাততালি দেওয়ার সাথে সাথে তুই পঞ্চম কদম পার হবি। বুঝতে পারছিস?
হু বুঝতে পারছি।
এখন আমি হাততালি দিবো। তুই পঞ্চম ধাপে উঠার জন্য রেডি তো?
হুম রেডি।
ফাহিম হাততালি দিলো, সাথে সাথে সাবিম মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পরে গেলো। আড্ডার সবাই ঘোর লাগা অবস্থায় ছিলো। সাবিম হটাত করে মাটিতে পড়ে যাওয়ায় সবার ঘোর কেটে গেলো। সবাই সাবিমের দিকে ছুটে গেলো। সাবিম, এই সাবিম উঠ।
শুভ্র বলল, মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছে, কেউ একজন ওর মুখে পানি ছিটা দে।
হাসিন এক দৌড়ে কলপাড় থেকে পানি এনে তার মুখে পানি ছিটিয়ে দিলো। সাথে সাথে সাবিম জেগে উঠলো। শুভ্র আনন্দিত গলায় বলল, সাবিমের জ্ঞান ফিরেছে, সাবিমের জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু সাবিম প্রথমেই যে কথা বলল সেটি হলো, ভ্যাআ ভ্যাআআ।
সবাই তো অবাক। ফাহিম বলল, সে ছাগল হয়ে গেছে আর আধাঘন্টার জন্য সে ছাগল হয়েই থাকবে। সাবিম আবার বলল, ভ্যা ভ্যা। তারপর তার পাশে হাসিনের জামা মুখ দিয়ে টানতে শুরু করলো।
ওই ব্যাটা, আমার জামা ছাড়! হাসিন ধমক লাগায়।
শান্ত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে, সত্যি সত্যি ছাগল হয়ে গেলো। মানে সিরিয়াসলি ছাগল হয়ে গেলো? এটাও সম্ভব?
প্যারানরমাল সাইকোলজির জগতে সব সম্ভব। ফাহিম হাই তুলতে তুলতে বলল।
শুভ্র বলল, তাই বলে ছাগল হয়ে যাবে? ব্যাটা অভিনয় করছে নাতো? দেখিতো একটা লাত্থি দিয়ে। বলে সাবিমকে দিলো এক রামলাত্থি। সাবিম, “ভ্যায়ায়ায়া” বলে চার পায়ে বারান্দার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়াতে লাগলো।
না বেটা সহজে মানবে না। শুভ্র বলল, ওই সাবিম, শোন এক্ষণি যদি আবার দুই পায়ে দাঁড়িয়ে মানুষ না হো, তাহলে এক্ষনি তোর যত সিক্রেট সব ফাঁস করে দিবো। তোর গার্লফ্রেন্ডের নাম ফাঁস করবো নাকি?
সাবিমের মধ্যে কোনই বিকার নেই। সে চার পায়ে হাটাহাটি করতেই থাকলো। ওইদিকে কয়েকটা কাগজ পড়ে ছিলো আর সেগুলো সে খেতে শুরু করলো।
ভাই ফাহিম আমি তোর সামনে আমার মাথা নিচু করছি। সাবিমকে সত্যি সত্যি তো তুই ছাগল বানায়ে দিলি। যদি ছাগল না হতো তাহলে এক্ষনি আমার কথা শুনে সে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়তো। ওই আবার অনেক ভরসা করে আমাকে ওর গার্লফ্রেন্ডের নাম বলছে। এটা ফাঁস হলে ওর বিপদ ছিলো। যেহেতু সে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে নি তার মানে সে সত্যি সত্যি ছাগল হয়ে গেছে।
ফাহিম গর্ব করে বলল, সাইকোলজির দুনিয়ায় সব সম্ভব। আমার তো নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না আমি কাওকে হিপনোটাইজ করে তাকে ছাগল বানিয়ে দিসি।
আচ্ছা এটা বলতো ফাহিম, শান্ত বলল, সাবিমকে তুই এতো প্রানী থাকতে ছাগলই বানালি কেন? অন্য কিছুও তো বানাতে পারতি! যেমন তাকে একটা কুত্তা বানিয়ে দিতে পারতি, হাতি বানিয়ে দিতে পারতি।
জানি না ভাই, ফাহিম বলল, ছাগলের কথাই আমার মাথায় প্রথমে আসছে।
হাসিন বলল, আচ্ছা, সাবিম যেহেতু ছাগল হয়েই গেছে তাহলে তাকে নিয়ে একটু মজা করি?
কিরকম মজা? শান্ত জিজ্ঞেস করলো।
দেখি আমি কয়েকটা ঘাস আনি।
এর এক ঘন্টা সাবিমের উপর নানারকম অত্যাচার চলল। তাকে প্রথমে ঘাস খাওয়ানো হলো এবং সে বেশ আগ্রহ নিয়ে ঘাস খেলো। শান্ত তার জন্য আমপাতা আনলো এবং সেটিও সে খুব আগ্রহ নিয়ে খেলো। ফাহিম শুধু একটু চিন্তিত ছিলো, দেখ এসব খাওয়াস না, ওর পেট খারাপ হতে পারে।
শুভ্র বলল, আরে আরেকবার মানুষ হয়ে গেলে তো এসব খাবে না। ছাগল থাকা অবস্থায় ওকে নাহয় একটু ঘাস,পাতা খাওয়াই।
সাবিম যেহেতু চার হাত পায়ে হাটাহাটি করছিলো, কয়েকজন তার পিঠে চড়ে বসলো। সাবিম বেশ কয়েকবার গা ঝাকুনি দিয়ে কিংবা ভ্যা ভ্যা বলে আপত্তি করতে চাইলো। কিন্তু কোন লাভ হলো না।
এক ঘন্টা হয়ে গেলো। রাতও হয়েছে। কিন্তু এখনো সাবিম ছাগলের মতো হাটাহাটি করেই যাচ্ছে। শুভ্র বেশ চিন্তিত গলায় বলল, ফাহিম, সাবিম তো আবার মানুষ হচ্ছে না। এ আবার মানুষ কখন হবে?
ফাহিমও বেশ চিন্তিত। সে বলল, এতক্ষণ তো তার মানুষ হয়ে যাবার কথা! সে এখনো হচ্ছে না কেন।
এখনো ফাহিম ছাগলের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু পরই হোস্টেল সুপার হোস্টেলের গেট লক করে দিতে আসবে। শুভ্র বলল, ফাহিম, তুই একে আবার যা করেই হোক মানুষ বানা, আবার একে হিপনোটাইজ কর। এক্ষনি তো মফিজ স্যার হোস্টেল লক করতে আসবে।
ফাহিম চিন্তিত মুখে বলল, বুঝলাম না। হিপনোটাইজের ইফেক্ট তো আধা ঘন্টার বেশি থাকে না। হিপনোটিক সাজেশান এমন একটা রিচুয়াল যেটা একটা মানুসষের কনশাস মাইন্ড কিছুক্ষণের জন্য অবশ করে যায়। তখন সাব কনশাস মাইন্ডকে যা সাজেশন দেই তাই মেনে নেয়। কিন্তু আধাঘণ্টার মধ্যেই তো কনশাস মাইন্ড জেগে উঠে। সাবিমের বেলায় যে কি হলো।
জ্ঞান ঝাড়া বন্ধ কর ফাহিম। সাবিমকে তুই ঠিক কর।
আচ্ছা দেখি।
আবার সেই একি দৃশ্য। ফাহিমের সামনে সাবিম বসে আছে। ফাহিম আবার সেই খুলিটা বের করলো। কিন্তু সাবিমের এদিকে কোন দৃষ্টি নাই। সে একবার বামে তাকাচ্ছে আর একবার ডানে তাকাচ্ছে। ফাহিম বলল, সাবিম তুই এই খুলিটার দিকে তাকিয়ে থাকবি।
কিন্তু সাবিমের ওই দিকে তাকানোর কোন আগ্রহ নেই। সে চার পায়ে উঠে ওইদিকে চলে এলো।
এই, ওকে ধরে আন কেউ। ফাহিম চেচিয়ে উঠে।
কয়েকজন সাবিমকে ধরতে যায়। কিন্তু সাবিম ছাগলের মতোই বারান্দার বিপরীত দিকে দৌড় দেয়। শেষে সাবিমকে টেনেহিচড়ে আবার ফাহিমের সামনে হাজির করা হয়। সাবিম ধস্তাধস্তি করতে থাকে আর ভ্যা ভ্যা বলে চিল্লাতে থাকে।
ফাহিম তাকে আবার হিপনোটাইজ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন লাভ হয় না। সাবিম ধস্তাধস্তি করতে থাকে। শেষে উপায়ান্তর না দেখে ফাহিম বলে, না, একে আর হিপনোটাইজ করা সম্ভব না এ অবস্থায়।
তারমানে কি? সাবিম সারাজীবন ছাগল হয়েই থাকবে? হাসিন প্রশ্ন করে।
ফাহিম ইতস্তত করে বলে, না সারাজীবন ছাগল হয়ে থাকবে না। হয়তো সকালেই সে ঠিক হয়ে যাবে।
ততোক্ষণে হোস্টেল সুপার মফিজ স্যার চলে এসেছেন। তিনি এমন হট্টগোল দেখে প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার, এখানে এতো হইচই কিসের?
ক্লাস সিক্সের ছেলে শাহীন বলল, স্যার সাবিম ভাইয়া ছাগল হয়ে গেছে।
ছাগল হয়ে গেছে? মানে কি? মফিজ স্যার প্রশ্ন করে।
ফাহিম গলা মৃদু খাঁকারি দিয়ে বলল, মানে স্যার, আমি একটু সাবিমকে হিপনোটাইজ করতে গেসিলাম। হিপনোটাইজ হয়ে সে ছাগল হয়ে গেলো। তারপর থেকে ছাগল হয়েই আছে, আর ঠিক হচ্ছে না।
মানে? স্যার বিভ্রান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেখলেন সাবিম চার পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।
স্যার প্রশ্ন করলেন, সাবিম, তুই ছাগল হয়ে গেছিস?
সাবিম বলল, ভ্যাআআআআ।
স্যার আরো হকচকিয়ে গেলো। সত্যি ছাগল হয়ে গেছে। এই সাবিম, তুই এক্ষনি দুই পায়ে উঠবি, তারপর কান ধরে দশ বার উঠবস করবি। এক্ষনি উঠ। স্যার হুংকার দিলেন।
কিন্তু সাবিমের কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে স্যারের উল্টা দিকে হাটা শুরু করলো।
ওই হারামজাদা থাম বলছি। মফিজ স্যার প্রচন্ড রেগে আছেন।এক্ষনি তুই যদি না উঠিস তাহলে সোজা তোকে হেড স্যারের কাছে নিয়ে যাব, রাত বিরেতে তামাশা হচ্ছে তাইনা?
কিন্তু সাবিমের কোনই প্রতিক্রিয়া নাই। এবার মফিজ স্যার প্রচন্ড রেগে গেলেন। তিনি ধাম করে সাবিমের পিছে একটা লাত্থি বসায়ে দিলেন। সাবিম, “ভ্যাআআআআ” বলে ওইদিকে ছুটে গেলো। মফিজ স্যার ভয় পেয়ে গেলেন। সত্যি সত্যি ছেলেটা ছাগল হয়ে গেছে নাকি?
ফাহিম ইতস্তত করে বলল, জি স্যার, দোষটা আমার। আমি আবার তাকে হিপনোটিক সাজেশন দিয়ে…
হিপনোটিক সাজেশান আবার কি?
না মানে, ইয়ে…এটা সাইকোলজির…
ব্যাস তোকে আর কথা বলতে হবে না। মফিজ স্যার বললেন, বুঝছি ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। একে এক্ষনি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
ফাহিম আর কিছু বলল না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সাবিমকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করাই শ্রেয় হবে।
আল্লাহ, একি মুসিবতে ফেললা তুমি? আমার হোস্টেলেই একজন ছেলেকে পাগল হতে হলো। আল্লাহগো কি কঠিন পরিক্ষায় ফেললা তুমি!
মফিজ স্যার তাড়াতাড়ি ফোন বের করে হেডস্যারকে ফোন দিলেন।
হেলো হেডস্যার, আমি মফিজ বলছি, স্যার মহাবিপদে পড়েছি স্যার, হোস্টেলের সাবিম নামের যে ছেলেটা আছে না, সে পাগল হয়ে গেছে, ছাগলের মতো আচরণ করছে।
ওপাশ থেকে হেডস্যার কিছু বলল। মফিজ স্যার বললেন, জী স্যার, আমি এক্ষনি একে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি একটু দয়া করে ব্যবস্থা করে দেন।
এরপর কয়েকটি নাটকীয় দৃশ্য ঘটলো। একটি এ্যাম্বুলেন্স আসলো। এ্যাম্বুলেন্সের কর্মীরা সাবিমকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে তাকে নিয়ে রওনা দিলো। সাবিমের সাথে আমি, শুভ্র, হাসিন আর মফিজ স্যারও রওনা দিলাম।
মানসিক হাসপাতালের মনরোগ চিকিৎসকরা সাবিমকে দেখে তো হতভম্ব। এরকম কেস খুব রেয়ার। তারা কিভাবে কিভাবে যেন ফাহিমের হিপনোটাইজের ব্যাপারটা জেনে ফেলল। তারা ফাহিমকে প্রশ্ন করলো,
মনরোগ ডাক্তারঃ তুমি তোমার বন্ধুকে শুনলাম কিছু একটা করেছো। যার ফলে তার এই অবস্থা।
ফাহিমঃ স্যার, আমি তাকে নিয়ে হিপনোটিক সাজেশানের একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। যার ফলে এই ঘটনা ঘটলো।
ডাক্তারঃ তুমি হিপনোটিক সাজেশানের ব্যাপারটা কোথা থেকে জেনেছো?
ফাহিম সব ঘটনা খুলে বলল।
ডাক্তারঃ তুমি কি জানো তুমি কি নিয়ে খেলাধুলা করেছো? হিপনোটিক সাজেশান হলো প্যারানরমাল সাইকোলজির অনেক ডিপ একটা সাবজেক্ট। অনেক কষ্ট ও সাধনা করে এই ব্যাপারটা শেখা লাগে। আমি খুব অবাক হচ্ছি যে তোমার মতো একটা বাচ্চা ছেলে হিপনোটিক সাজেশানের ব্যাপারটা ব্যবহার করতে পেরেছে।
ফাহিম কিছু বলল না। তার কেন জানি খুব লাজ্জা লাগছে।
ডাক্তার বললেন, তবে এই ব্যপারটা শিখলেই হলো না। এটিকে কন্ট্রোল করাও শিখতে হবে। এই হিপনোটিজম ব্যবহার করে যদি কেও ভুলভাল সাজেশান দিয়ে বসে তাহলে অনেক ধরনের সমস্যা হয়। তুমি তোমার বন্ধুকে সাজেশান দিয়েছো সে যেন ছাগল হয়ে যায়। এটি ছিলো একটি ভুল সাজেশান। এখন এমনও হতে পারে তোমার বন্ধু এখন চিরকালের জন্য ছাগল হয়েই কাটাবে।
ফাহিম কিছু বলল না। সে এখন রীতিমতো ভয় পাচ্ছে। সাবিম যদি চিরদিনের জন্য ছাগল হয়ে যায় তাহলে কি হবে।
এই ঘটনার অনেকদিন হয়ে গেলো। সাবিম আর ছাগল থেকে মানুষ হতে পারলো না। তার বাবা-মা তাকে নিয়ে দেশের বাহিরে চলে গেলো।
ফাহিমকে স্কুল থেকে সাসপেন্ড করা হলো। এরপর ফাহিমের সাথে কি হয়েছে তা আর জানা যায়নি।
*
*
*
*আমি এই গল্পে যে হিপনোটিক সাজেশানের কথা বলেছি সেটি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের উচিত যাকে হিপনোটাইজ করছি তাকে যেন কখনো ভুল সাজেশান না দিই।